শরৎকুঠি
পুরুলিয়ার ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে যাত্রা শুরু করে বাঁকুড়া পার হয়ে দ্বারকেশ্বর নদ ঘাটালের কাছে পুরুলিয়া থেকে আগত শিলাই বা শিলাবতী নদীর হাত ধরে রূপনারায়ন নাম নিয়ে হুগলি নদীতে মিশে। আমরা আজ দাঁড়িয়ে আছি সেই নদীর-ই তীর পানিত্রাসে বা সামতাবেড়ে। আমরা যে জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে আছি নদী আগে এখানে ছিল। বর্তমানে নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করেছে আর এর পারে বসেই তৈরি হয়েছে কিছু অমূল্য সৃষ্টি। কি করে? চলুন খুঁজে দেখা যাক-
শরৎ কুঠি ( সামতাবেড়) |
হুগলি জেলার দেবানন্দপুর 1876 সালের পনেরোই সেপ্টেম্বর 12 83 সালের 31 শে ভাদ্র জন্ম ন্যাড়ার। ছোটবেলা থেকেই বালক ন্যাড়ার পড়াশুনার থেকে আমবাগানে ফরিং ধরাতেই বেশি উৎসাহ ছিল। বালক ন্যাড়া মানে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। লেখা পড়া শুরু হয় দেবানন্দপুর প্যারি পন্ডিতের পাঠশালা। সেখান থেকে পরিবারের অভাবের তাড়নায় চলে যেতে হয় মামাবাড়ি ভাগলপুরে। এখানে এসে পড়াশুনায় উন্নতি হলেও সংসারের অভাব পিছু ছাড়ল না। ফিরে আসতে হলো আবার দেবানন্দপুর কিন্তু সেখানেও অভাব পিছু ছাড়ল না তাই আবার ভাগলপুরে যেতে হলো শরৎ-এর বাবা মতিলালকে। এখানেই পুনরায় বাড়তে থাকে শরৎ-এর সাহিত্য, প্রীতি। চলতে থাকে গান,বাজনা, যাত্রা, থিয়েটার, মহড়া।
এরপরে শরৎ এর ভুবনমোহিনী দেবী মারা যান 1895 সালে। মতিলাল বাবুকে চলে যেতে হয় খজ্জরপুরে। সেখানে নতুন বাসাতেই শরৎ-এর চলতে থাকে সাহিত্যচর্চা, গড়ে তোলেন সাহিত্য চক্র। চলতে থাকে লেখালেখি। এখানেই একদিন পাঠ হয় "অভিমান" গল্পটি, পরিচিতি পায় শরৎচন্দ্র। এরপর বাবার কাছ থেকে পাওয়া পৈতৃক সম্পত্তির নামে এই সাহিত্য বৈরাগীর ওপর ভর করেই মজফ্ফরপুর আবার ভাগলপুর, বেঙ্গুন পেরিয়ে এসে পড়েন কলকাতার বালিগঞ্জে। এর মধ্যেই জীবনে ফেলেছে অনেক উত্থান-পতন। পিতৃবিয়োগ হয়েছেন, বিয়ে করেছেন, অনেক ছোটখাটো চাকরিও কিন্তু সাহিত্য থামেনি কখনো। তারপর শিবপুরের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে শরৎচন্দ্র বাসাবাড়িতে রূপনারায়ণের তীরে পানিত্রাস-এর নির্জন শান্ত প্রকৃতিতে।
হাওড়া থেকে South Eastern Railway খড়গপুর, মেদিনীপুর বা পাঁশকুড়া লোকালে 50km দূরে 1 ঘন্টা 15 মিনিট সফরে দেউলটি স্টেশন। এখান থেকে 3.5 km টোটোতে পানিত্রাস বা সামতাবেড় গ্রাম। দেউলটি স্টেশনের বাইরে বা দেউলটি বাজারে টোটোতে উঠে শরৎকুঠি বললেই 15-20 মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবেন শরৎকুঠি। টোটো ভাড়া নেবে 15 টাকা।
1919সালে শরৎচন্দ্র 1100 টাকার বিনিময়ে এই জায়গাটি কেনেন। 1923 সালে স্থানীয় মিস্ত্রি গোপাল দাস এই বাড়ির কাজ শুরু করেন। শরৎচন্দ্র এখানে একটি পুকুর নির্মাণ করেন।
এইটাই সেই রামের কার্তিক গণেশ-এর পুকুর। যেটাকে নারায়নী হাসিয়া বলিলতন "রামের কার্তিক গণেশ কাজে লাগবে আমার শ্রাদ্ধের সময়।" সর্বমোট 17000 টাকা খরচ হয় এই পুরো নির্মাণের জন্য। আর এইটাই সেই পেয়ারা গাছ, যেখান থেকে রাম "রামের সুমতি" গল্পে পেয়ারা ছুড়ে বৌদির মাকে আঘাত করতে গিয়ে বৌদির কপাল ফাটিয়ে ফেলেছিল। তার ফলে যে কি দুর্ভোগ ভোগ করতে হয়েছিল রামকে সে শরৎ প্রেমীরা সবাই জানে।
বাস্তবে এ পেয়ারা গাছটি শরৎচন্দ্র নিজের হাতে লাগিয়েছিলেন । এখানে বসে উনি লিখতেন আর পাশ দিয়ে বয়ে চলত রূপনারায়ন নদী।
এই ঘরটিতে শরৎচন্দ্র হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন গরিব-দুঃখীদের আর এই ঠাকুর ঘরে নিত্য পূজা হয়। এই রাধা-কৃষ্ণ মূর্তিটি দিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস। এই ঠাকুরদালানটি পেরিয়ে সামনে একটি রান্নাঘর। 1978 সালের বন্যায় পুরো পানিত্রাসে ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং এই রান্নাঘরটি ভেঙে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে বাকি নির্মাণটি রক্ষা পেয়ে যায়। পরে রান্নাঘরটি হেরিটেজ কমিশন থেকে পুনর্নির্মাণ করা হয় ও পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন অ্যাক্ট অনুযায়ী 2001 সালে বাড়িটিকে হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়। 2009 সালের পুরো বাড়িটি সংস্কার করা হয়।
এই বাড়িটির চারধারে দালান ও মাঝখানে ঘরগুলি অবস্থিত। এই বাড়িতে তিনি রচনা করেন রামের সুমতি ও মহেশের মত অনেক রচনা। এই বাড়িটি শুধু শরৎচন্দ্রের নয়। এখানে থাকতেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী মোক্ষদা বা হিরন্ময়ী দেবী ও তার ভাই বেলুড় মঠের সন্ন্যাসী স্বামী ভেদানন্দ।
একসময় এই বাড়িই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিরাপদ আশ্রয়। সামতাবেড়ে 12 বছর কাটানোর পর তিনি ফিরে যান কলকাতায়। 1938 সালের 12 জানুয়ারি ভিক্টোরিয়া টেরাস্ পার্ক নার্সিংহোমে তাঁর অস্ত্রোপচার হয় যকৃতে ক্যান্সারের কারণে। তার চার দিন পর 16 জানুয়ারি সকালে তিনি বাঙালির মনে অমরত্ব লাভ করেন।
শরৎ স্মৃতি উপলক্ষে 21শে জানুয়ারি থেকে 27শে জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিবছর পানিত্রাস উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে শরৎ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। যা এবার 48 বছরে পড়ল।
আমাদের কথাশিল্পী বিলাসী না হলেও ছিলেন খুব শৌখিন মানুষ। অন্যদিকে তিনি ছিলেন সমাজের পীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের মুখের ভাষা। এই প্রসঙ্গে অজিত কুমার ঘোষ বলেন-
"শরৎচন্দ্র সোজাভাবে স্পষ্টভাষায় ও দুঃখ-বেদনার কারুন্যে সিক্ত করিয়া সমাজের সমস্যা তুলিয়া ধরিলেন এবং আমাদের প্রচলিত সংস্কার, নীতিবোধ ও ধর্মবোধের অন্যায় ও জবরদস্তির চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিলেন। ইহার ফলে আমাদের বদ্ধ অচলায়তনের দ্বার যেন হঠাৎ খুলিয়া গেল এবং সেই মুক্ত দ্বার দিয়া যত আলো ও বাতাস আসিয়া মুক্তির আনন্দে আমাদিগকে চঞ্চল করিয়া তুলিল।"
শরৎচন্দ্র বাংলার এমন একজন সাহিত্যিক যে শুধুমাত্র সাহিত্যের উপর ভর করে ছোটবেলার দারিদ্রতাকে হার মানিয়ে সচ্ছল জীবনে পা রেখেছিলেন ও গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন।
বিশাল শোকযাত্রার মাধ্যমে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে জনপ্রিয় কথাশিল্পী শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
No comments:
Post a Comment
If you have any question let me ask